আগরতলাঃ
রাজধানীর অন্যতম চর্চিত হত্যা মামলা বোধিসত্ব দাস হত্যা মামলায় পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা ও দায়রা আদালতের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। রাতের শহরের কাল অন্ধকারময় ভয়াবহ চিত্রকে ফুটিয়ে তোলা এই মামলায় রাজধানীর বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম জড়িত থাকায় এই মামলাকে প্রভাবিত করার অনেক চেষ্টার পরেও দক্ষ ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিনাম স্বরুপ আজ প্রকৃত দোষীরা শাস্তির মুখোমুখি। আর এর কৃতিত্ব অবশ্যই রাজধানীর পশ্চিম থানার পুলিশের। পশ্চিম থানার ১৭২/২০১৯ নাম্বারের এই মামলায় বিশেষ করে এই মামলার তদন্তকারী অফিসার সুমন উল্লা কাজির নিখুঁত এবং বৈজ্ঞানিক তদন্ত প্রকৃয়া এই মামলার সফলতায় অন্যতম ভুমিকা রেখেছে। অভিযুক্ত চারজনকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে মাননীয় আদালত। আগামীকাল অর্থাৎ শনিবার তাদের শাস্তি ঘোষনা করবে আদালত। তবে সর্বোচ্চ আজীবন কারাবাসের শাস্তি হবার সম্ভাবনা প্রবল। এখন আমরা ২০১৯ সালের ৩রা আগষ্টের রাতে শহরের ওরিয়েন্ট চৌমুহনি ও জেকশ্যান গেইট এলাকার মাঝামাঝি সারদা মেডিক্যাল এজেন্সির ঠিক সামনে কি ঘটে ছিল , সেই রাতের ঘটনার সম্পুর্ন তথ্য তুলে ধরব। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই অত্যাধিক চর্চিত হত্যা মামলার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হলেও আমরা এই প্রতিবেদনে ঐ রাতের ঘটনার সঠিক তথ্য তুলে ধরব। ঠিক কি ঘটেছিল ওই রাতে। প্রতি মুহুর্তের ঘটনা বিস্তারিত।
শহরের বনেদী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কালিকা জুয়েলারী হাউজের কর্নধারের ছেলে সুমিত চৌধুরী, কলেজটিলা এলাকার ঠিকেদার সুমিত বনিক, ট্রাফিক ইনস্পেকটর সুকান্ত বিশ্বাস একত্রে রাত্রিকালীন আনন্দলিলায় শহরে বেরিয়েছিল। মদ্যপান করে সুমিত চৌধুরীর TR01AJ 0222 নাম্বারের volkwagon কোম্পানির দামী গাড়ি করে শহরে টহলদারী করছিলেন তারা তিনজন। মদ্যপান করে গভির রাত পর্যন্ত হাই ভলিউম মিউজিক লাগিয়ে দামি গাড়িতে করে বেলেল্লাপনা করা তাদের রোজদিনের রুটিন ছিল। হঠাতই ট্রাফিক ইনস্পেকটর সুকান্ত বিশ্বাসের প্রশ্রাবের বেগ পায়। আর গাড়িটি তখন জেকশন গেইট থেকে ওরিয়েন্ট চৌমুহনির দিকে যাচ্ছিল। আর এর মাঝামাঝি সারদা মেডিক্যাল এজেন্সির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রশ্রাব করতে নামে সুকান্ত। আর সেখানেই বন্ধু কিশোর পালের সাথে বসে বিয়ার পান করছিল বোধীসত্ব। ঘড়ির কাটায় সময় তখন রাত প্রায় ১২টা, অর্থাৎ ৩রা এবং ৪ঠা আগষ্টের মাঝামাঝি সময়। সুকান্ত পাল দোকানের সামনেই প্রশ্রাব করায় তাঁকে বাধা দেয় কিশোর, বলে দোকানের সামনে কেন প্রশ্রাব করছেন। আর আগরতলায় ট্রাফিক দপ্তরে কাজ করার নিরিখে শহরের বনেদী থেকে শুরু করে বখাটে সকলের সাথে মধুর সম্পর্ক তৈরী করা নেশাগ্রস্থ সুকান্ত এতে খেপে যায়, তেড়ে যায় কিশোরের দিকে । আর সেই মুহুর্তে বন্ধুর হয়ে এগিয়ে আসে বোধিসত্ব। আর তখন বোধিসত্বের সাথে সুকান্তের হাতাহাতি শুরু হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়িতে থাকা সুমিত চৌধুরী এবং সুমিত বনিক গাড়ি থেকে নেমে এসে বোধিসত্বের উপর চড়াউ হয়। তাঁকে সারদা মেডিক্যাল এজেন্সির বারান্দার সিঁড়িতে ফেলে বেদম প্রহার করতে থাকে এরা তিন জন। তার মাধা সিঁড়িতে মেড়ে থেতলে দেয় তিন অভিযুক্ত। এর মধ্যেই সেখানে চতুর্থ অভিযুক্তের আগমন। মসজিদ পুট্টি এলাকার সমাজদ্রোহী হিসাবে পরিচিত উমর শরিফ ওরফে সোয়েব তার TR01W7643 নাম্বারের স্কুটিতে করে একই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাতই বাকি তিনজনকে দেখে দাঁড়িয়ে পরে সোয়েব। তার কানে আসে সুকান্ত স্যারকে কেউ মেরেছে। আর তাতেই স্কুটি ফেলে তেড়ে যায় সোয়েব। তাদের তিনজনের কাছ থেকে বোধিসত্বকে কেড়ে নিয়ে পকেট থেকে একটি ধারালো ছুরি বের করে সেই সারদা মেডিক্যালের সামনেই বোদ্ধিসত্বের পেট ও অন্যান্য অঙ্গে বেশ কয়েকটি আঘাত করে। আর এই সব ঘটনা ঘটনাস্থলে দাড়িতে চাক্ষুষ করছিল বোধিসত্বের বন্ধু কিশোর পাল এবং সেই এলাকার এক পানের দোকানের মালিক বাসু কর। সোয়েবের চাকু মারার সাথে সাথেই গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় বাকি তিন অভিযুক্ত।
তার পর সোয়েব চাকু নিয়ে তেড়ে আসে কিশোরকে মারার জন্য। যদিও সেই পর্যায়ে পানের দোকানে বাসুর অনুরোধে রক্ষা হয় কিশোরের। ঘড়িতে তখন ১২টা ৩০। ঘটনাস্থল থেকে স্কুটি নিয়ে পালিয়ে যায় সোয়েব। সাথে কিশোর এবং বাসুও এক বাইকে করে পালিয়ে যায়। সোয়েব ফায়ার ব্রিগেড চৌমুহনি থেকে কের চৌমুহনির দিকে মোড় নেয় এবং কিশোর ও বাসু পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে কিশোর তার মাকে সব কথা জানায়। পরে কিশোর তার মাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে বোধিসত্বকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু ততক্ষনে দমকল কর্মীদের সহযোগিতায় বোধিসত্বকে জিবি হাসপাতালে পাঠান হয়েছিল।
হাসপাতালে পুলিশের কাছে জবান বন্দিতে বোধিসত্ব সব বলে যায়। পরে ১৬ই আগষ্ট কোলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিতসারত অবস্থায় বোধিসত্বের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে এই মামলাকে নয়ছয় করার বহু প্রয়াস এবং অপচেষ্টা করা হয়। মামলার প্রধান সাক্ষী কিশোর শেষ পর্যন্ত তার জবানবন্দিতে অনড় থাকেলও , প্রচন্ড চাপে গা ঠাকা দেয় পানের দোকানের মালিক প্রত্যক্ষ দর্শী বাসু কর। তবে সোয়েবের স্কুটি এবং ব্যবহৃত ছুরি থেকে পাওয়া রক্তের সাথে বোধিসত্বের রক্তের ডিএনএ মিলে যাওয়া এবং প্রায় ৫৬ জনের সাক্ষী গ্রহন এবং বহু শুনানির পর এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় চার অভিযুক্তের অপরাধ প্রমান করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ততকালীন পশ্চিম থানার সাব ইন্সপেকটর সুমন উল্লা কাজির সুদক্ষ ও বৈজ্ঞানিক তদন্ত প্রকৃয়ার ফল স্বরুপ বিচার পেল বোধিসত্বের পরিবার। সন্তান এবং এই মামলার শুনানী চলাকালীন স্বামিকেও হারান বোধিসত্বের মা রঞ্জনা দাস। মাননীয় আদালতের এই ঐতিহাসিক রায়ে আজ কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন অসহায় এই মা।